আঃ রাজ্জাক বি.এ.বি.এড:
তিলে তিলে গড়ে উঠা তিলোত্তমা সখীপুরের স্বপ্ন দ্রষ্টা শ ম আলী আসগর বিগত ১৯৩০ সালে তৎকালীন বাসাইল থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী গড়গোবিন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব উমেদ আলী এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ সুরাইয়া বেগম। পিতা-মাতার পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিনি সকলের বড়ো। তিনি সখীপুর ফ্রি প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৪২ শিক্ষা বর্ষে কালিহাতী থানার ‘বল্লা করোনেশন হাইস্কুলে’ পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। লজিং থাকেন তাঁদের আদি নিবাস বানিরা-কোনাবাড়ী গ্রামে। গ্রীষ্মকালীন বা হিন্দু-মুসলিম পর্বের ছুটিতে বাড়ী আসতেন পায়ে হেঁটে অতি কষ্ট করে। দুর্গম পাহাড়ী রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে তিনি ভাবতেন, ‘যদি সখীপুরে একটি হাইস্কুল থাকতো, তাহলে তো আমাকে এতো কষ্ট করতে হতো না।’ প্রকৃতপক্ষে তাঁর এই ভাবনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়- ‘সখীপুর পিএম পাইলট হাইস্কুল।’ এই শিক্ষানুরাগী নবীন যুবক ১৯৪৮ সনে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বাড়ি এসে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষা গুরু বাহাউদ্দীন পন্ডিত সাহেবের স্মরণাপন্ন হন। তাঁর মাধ্যমে একটি মিটিং আহ্বান করে মাধ্যমিক শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। যার প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সখীপুর পিএম পাইলট হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।
ছবিতে তিলোত্তমা সখীপুরের স্বপ্ন দ্রষ্টা শ ম আলী আসগর
শ ম আলী আসগর সাহেব ১৯৫০ সনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সমাজ সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাই উচ্চতর শিক্ষা লাভের সুযোগ তাঁর ঘটেনি। তিনি সার্বক্ষণিকভাবে নব প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুল, সমাজ, রাস্তা-ঘাট, হাজামজা পুকুর, হাঁট-বাজার সংস্কার তথা অজপাড়াগাঁ গড়গোবিন্দপুর-সখীপুরের সার্বিক উন্নয়নে ব্রতী হন। হাইস্কুলের ছাত্র সংগ্রহ, জায়গীরের ব্যবস্থা, শিক্ষক খুঁজে আনা, বেতন-ভাতা প্রদানকল্পে মুষ্টির চাল, মৌসুমী ফসল সংগ্রহ কার্যক্রমে সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। অনেক সময় স্কুল ফান্ডে কোন প্রকার টাকা-পয়সা জমা থাকতো না। সেক্ষেত্রে আলী আসগর সাহেব তাঁর বাবার গোলার ধান বিক্রি করে টাকা দিতেন। কোনো এক সময় তিনি নিজের গায়ের জামা বিক্রি করে শিক্ষক বেতন প্রদানে শরীক হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৎকালীন সময়ে ময়মনসিংহ জেলা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ‘সখীপুর দাতব্য চিকিৎসালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে এলাকাবাসী চিকিৎসাসেবা পেতে থাকে। উক্ত ‘সখীপুর দাতব্য চিকিৎসালয়টি বর্তমানে ‘সখীপুর উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র’ হিসেবে চালু রয়েছে।
তৎকালীন সময়ে অত্র পাহাড়ী এলাকায় প্রায় প্রতি রাতেই চুরি-ডাকাতি হতো। থানা অনেক দূরে থাকায় এর প্রতিকারের ব্যবস্থা ছিলনা। তাই এলাকাবাসী সখীপুরে থানা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। থানা দাবীর প্রাথমিক প্রস্ততিকল্পে শ ম আলী আসগর ১৯৫৬ সনে ‘দি হিলি ইউনাইটেড এসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ‘সখীপুর থানা’ দাবী উত্থাপিত হয়। পরবর্তীতে এই সংগঠনকে ‘সখীপুর থানা দাবী কমিটি’ নামে রূপান্তরিত করা হয়। সর্বসন্মতিক্রমে তৎকালীন বহেড়াতৈল ইউনিয়নের স্বনামধন্য চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ শামস-ই-তাবরীজ উক্ত কমিটির সভাপতি এবং শ ম আলী আসগর সাহেব সেক্রেটারী মনোনীত হন। সন্মানিত সদস্য পদে মনোনীত হন তৎকালীন বাসাইল-কালিহাতী থানার অন্তর্ভুক্ত কাকড়াজান ,কালিয়া, গজারিয়া, যাদবপুর ও হাতীবান্ধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এই কমিটির মাধ্যমে সখীপুর থানা স্থাপনের দাবী আরো অধিকতর বেগবান হয়।
শ ম আলী আসগর সাহেব ছাত্র জীবন থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচন, ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং খাদ্যের যোগানদার। প্রতিদিন শত-শত মুক্তিযোদ্ধার অন্ন যোগাতেন তিনি। দীর্ঘ নয় মাস তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। অবশেষে, ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সমাজ, এলাকা তথা দেশ গড়ার কাজে লেগে যান এই কর্মবীর।
ইতোমধ্যে সখীপুর পি এম পাইলট হাইস্কুলের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আলী আসগর সাহেবের কল্যাণ হস্তের পরশ আজীবন লেগে ছিল স্কুলটির সার্বিক উন্নয়নে। তিনি উক্ত বিদ্যালয়ের জন্য মোট ৭৭ শতাংশ জমি দান করেন। বর্তমানে বিদ্যালয়টি কলেজ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে সরকারী করণ সাপেক্ষে ‘সখীপুর পিএম পাইলট মডেল গভঃ স্কুল এন্ড কলেজ’ নাম ধারণ করেছে।
১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের ‘কিংবদন্তি’ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মোচনকল্পে ‘মুজিব কলেজ’ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজ প্রতিষ্ঠালগ্নে আলী আসগর সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কলেজটি বর্তমানে সরকারী হয়েছে।
সময়ের প্রেক্ষাপটে অনিবার্য কারণ বশত ১৯৭৬ সালে পাহাড়ী জনতার প্রাণের দাবী ‘সখীপুর থানা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মোকতার আলী চেয়ারম্যান এবং আলী আসগর সাহেবের বাড়ী হতে আনীত চেয়ার, টেবিল ব্যবহার করে গজারিয়া ইউনিয়ন কমিউনিটি সেন্টারে সর্বপ্রথম থানার দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়। শুধু তাই নয়, সখীপুর থানার প্রথম সার্কেল অফিসার জনাব জুলফিকার হায়দারের আবাসন ব্যবস্থা করেন উঁনারা দু’জন মিলে। শ ম আলী আসগর দীর্ঘদিন সখীপুর থানা কমিটির সেক্রেটারী পদে বহাল ছিলেন।
এলাকার শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ কল্পে তিনি নিজ উদ্যোগে ‘সূর্য তরুণ শিক্ষাঙ্গণ’ নামে একটি প্রি-ক্যাডেট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের সহোদর ছোট ভাই জনাব এমও গণিকে (এমএসসি) অধ্যক্ষ নিয়োগ করেন। ১৯৮১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রথম-পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষাঙ্গনটি ধাপে ধাপে হাইস্কুল থেকে কলেজ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আলী আসগর সাহেব অত্র প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বত্ব দখলীয় ১৫০ শতাংশ জমি দান করেছেন।
এলাকায় নারী শিক্ষা বিস্তার কল্পে ১৯৮৪ সালে ‘সখীপুর পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। চাহিদা অনুযায়ী ১৫০ শতাংশ জমির মধ্যে ১৩৯ শতাংশ জমি দান করেন জনাব আলহাজ্ব মোকতার আলী চেয়ারম্যান এবং বাকি ১১ শতাংশ আবাদি জমি ছেড়ে দেন আলী আসগর সাহেব। বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সার্বিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে আলী আসগর সাহেব গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়ে ‘সখীপুর উপজেলা জনকল্যাণ সোসাইটি’ নামক একটি সমিতি গঠন করেন। এই সোসাইটির মাধ্যমে উপজেলা ব্যাপী ‘তৃতীয় শে্িরণর বৃত্তি পরীক্ষা’ চালু করা হয়। বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মহোদয়ের হাত দিয়ে প্রথম বৎসরের দশটি ট্যালেন্টপুল সহ মোট বাইশ জনকে বৃত্তির টাকা প্রদান করেন।
এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় ১৯৮৬ সালে তিনি ‘সখীপুর এতিম খানা’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক ভাবে ‘জন কল্যাণ সমিতি’ গৃহে এতিমদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে উপজেলা পরিষদের বরাদ্দকৃত অর্থে একটি গৃহ নির্মাণ করতঃ এতিমখানা স্থানান্তরিত করা হয়। সখীপুর পৌরসভার ০৬ নম্বর ওয়ার্ডের চামড়া পচা পুকুর পাড়ে উক্ত এতিমখানাটি অদ্যাবধি অবস্থিত আছে।
লাল মাটির কৃতিসন্তান, সাবেক সাংসদ, আধুনিক সখীপুর গড়ার নিখুঁত রূপকার প্রয়াত কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান নিজস্ব উদ্যোগে ১৯৯৫ সনে উচ্চতর নারী শিক্ষা বাস্তবায়নকল্পে ‘সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর স্বনামধন্য পিতা আলহাজ্ব মোকতার আলী চেয়ারম্যান সাহেবের দানকৃত জমিতে এই কলেজ স্থাপিত হয়। শ ম আলী আসগর সাহেব ‘সূর্য তরুণ শিক্ষাঙ্গন’ সংলগ্ন জমি মহিলাকলেজের জন্য দান করেন। শুধু তাই নয়, কলেজের সার্বিক উন্নয়নে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করেন তিনি। কলেজটি বর্তমানে বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
স্বাধীনতা লাভের পর তিনি ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা’র অনুমোদন সাপেক্ষে সখীপুর থানা শাখা চালু করেন। আজীবন তিনি উক্ত সংস্থার সভাপতি পদে বহাল ছিলেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি ‘সখীপুর হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসায়’ প্রতিষ্ঠা করেন। এসব ছাড়াও তিনি আরো অনেক জনহিতকর কার্যাবলী সম্পাদন করেছেন। তন্মধ্যে এলাকার রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও পুনঃসংস্কার, ‘সখীপুর হাট’ প্রতি শুক্র ও মঙ্গলবার চালু, শালগ্রামপুর বাজার ও ‘নদী বন্দর’ প্রতিষ্ঠা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন নিষ্ঠাবান ধর্মানুরাগী, সংস্কৃতিমনা ও ক্রীড়ামোদী ছিলেন। পারিবারিক জীবনে মোসাম্মৎ জায়েদা বেগম তাঁর সুযোগ্যা সহধর্মিণী। তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ে মোট চার সন্তানের জনক। বড়ো মেয়ে লিলি জেয়াসমীন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। বড়ো ছেলে জাহিদ ইকবাল জাহাঙ্গীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে আরিফ ইকবাল আলমগীর ‘সূর্য তরুণ শিক্ষাঙ্গণ স্কুল এন্ড কলেজ’ এর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে দায়িত্বরত অবস্থায় মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়। গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে অকেজো অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। ছোট মেয়ে মিলি জেসমীন শাহরীন একজন চাকুরীজীবি।
এই অক্লান্ত পরিশ্রমী সমাজ সেবক, সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখায়ব বিশিষ্ট বিপ্লবী লৌহমানব, বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী একজন সাদা মনের মানুষ বিগত ২০১৪ সালের ২রা জুলাই ইহধাম ত্যাগ করেন। আমি সুফী মতাদর্শে বিশ্বাসী, মারেফতী-মুর্শিদী-বাউল সঙ্গীতের যোগ্য সমঝদার, ক্ষণজন্মা এই মহৎ প্রাণ মানুষটির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আমীন!!
–লেখক: সাবেক সিনিয়র শিক্ষক, সখীপুর পিএম পাইলট মডেল গভঃ স্কুল এন্ড কলেজ, সখীপুর, টাঙ্গাইল।
–এসবি/সানি
Leave a Reply