অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে গড়ে উঠা বর্তমান তিলোত্তমা সখীপুরের আসল সূতিকাগার হচ্ছে তৎকালীন “সখীপুর পল্লী মঙ্গল (পিএম) হাই স্কুল”। পরবর্তীতে প্রতি থানায় একটি বালক ও একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পাইলট স্কিমের আওতায় আসার প্রেক্ষিতে “পাইলট” শব্দটি যুক্ত হয়েছে। গড়গোবিন্দপুর-সখীপুর এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে ১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দে সখীপুর পি এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা লগ্নে গড়গোবিন্দপুর গ্রামের কৃতিসন্তান, সমাজ হিতৈষী ও বিশিষ্ট দানবীর শেখ মোহাম্মদ হায়েত আলী সরকার ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘সখীপুর ফ্রী প্রাইমারী স্কুল ‘সংলগ্ন ১৪০ শতাংশ জমি দান করেন। উক্ত জমিতে নির্মিত দু’চালা টিনের ঘরে শুরু হয় হাইস্কুলের পাঠদান কার্যক্রম । সময়ের আবর্তে সেই ভাঙা টিনের ঘর, কর্দমাক্ত খেলার মাঠ এখন আর নেই। ধাপে ধাপে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সম্প্রসারণ ও পরিমার্জন হয়ে শিক্ষাঙ্গণটি বর্তমানে পৌঁছে গেছে উন্নতির চরম শিখরে। আধুনিক সখীপুর গড়ার নিখুঁত রূপকার, সাবেক সাংসদ প্রয়াত কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান সাহেবের কল্যাণ হস্তের পরশে শিক্ষাঙ্গণে শোভা পাচ্ছে বহুতল বিশিষ্ট অট্টালিকা সমূহ। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি সাপেক্ষে বিদ্যালয়টিকে তিনি কলেজ পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র সাবেক সাংসদ জনাব অনুপম শাহজাহান জয় এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সাম্প্রতিক কালে বিদ্যালয়টি সরকারী করণ হয়েছে। আংশিক পরিবর্তন সাপেক্ষে নাম করণ করা হয়েছে “সখীপুর পিএম পাইলট মডেল গভঃ স্কুল এন্ড কলেজ”।
উক্ত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমি দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা হায়েত আলী সরকার ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাসাইল থানার গড়গোবিন্দপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ নায়েব আলী সরকার। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বাসাইল থানার কাউলজানী গ্রামে। তাঁর পিতামহ শেখ হোসেন আলী সরকারের ছিল ছয় ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেদের নাম হচ্ছে (১) শেখ নায়েব আলী সরকার (২) শেখ বাবর আলী সরকার (৩) শেখ গয়ের আলী সরকার (৪) শেখ তরপ আলী সরকার (৫) শেখ মোন্তাজ আলী সরকার ও (৬) শেখ ইমতাজ আলী সরকার। একমাত্র মেয়ের নাম হচ্ছে শেখ কররানী বেগম। শেখ হায়েত আলী সরকারের পিতা শেখ নায়েব আলী সরকার কাউলজানী থেকে গড়গোবিন্দপুর গ্রামে আগমন করেন বলে জানা যায়।
ধনাঢ্য পিতার একমাত্র ছেলে হিসেবে শেখ হায়েত আলী সরকার অগাধ ভূসম্পত্তির স্বত্বাধিকারী হন। পাইলট স্কুল ছাড়াও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,কবরস্থান, হাট-বাজার এবং মসজিদের জন্য জমি দান করেছেন। পাকিস্তান আমলে ‘সখীপুর দাতব্য চিকিৎসালয়’টি তাঁর দানকৃত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত দাতব্য চিকিৎসালয়টি বর্তমানে “সখীপুর উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র” হিসেবে চালু রয়েছে। ১৯৫৬ সনে সখীপুর থানা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা শ ম আলী আসগর কর্তৃক স্থাপিত “দি হিলি ইউনাইটেড এসোসিয়েশন” নামক সংগঠনের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি আজীবন সামাজিক সৎকাজে দান-খয়রাত করে গেছেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস কাউলজানী গ্রামে অবস্থিত পূর্ব টাঙ্গাইলের একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘কাউলজানী নওশেরীয়া হাই মাদ্রাসায়ও তিনি অকাতরে দান করেছেন। তাঁর নিঃস্বার্থ অবদান আজো সকলের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
এই উদারমনা দানবীর, মহৎপ্রাণ, মহ মণিষী বিগত ১৯৭৯ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্বীয় সহধর্মিনী বাছিরন নেছা সহ দুই পুত্র ও তিন কন্যা সন্তান রেখে যান। পুত্র গণ হচ্ছেন (১) আলহাজ্ব আবদুল বারেক সরকার এবং (২) শেখ মোহাম্মদ হাবীব সরকার। কন্যা তিন গণের নাম (১) শেখ রিজিয়া বেগম (২) শেখ সাইরন বেগম ও (৩) শেখ জবেদা বেগম।
পিতার মতো আলহাজ্ব আবদুল বারেক সরকারও একজন সমাজ সেবক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। তিনি পাইলট স্কুলের হোস্টেল গৃহ নির্মাণ করার জন্য মোট ৩১শতাংশ আবাদী জমি দান করেছেন। উক্ত জমিতে “শেখ হায়েত আলী ছাত্রাবাস” নামে একটি হোস্টেল খোলা হয়েছে। তিনি দীর্ঘ মেয়াদে উক্ত বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির দাতা পর্যায়ের সদস্য পদে বহাল আছেন।
হায়েত আলী সরকারের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ মোহাম্মদ হাবীব ছাত্রাবস্থায় একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসেন বীরের বেশে। আত্মনিয়োগ করেন দেশমাতৃকার সেবায়। নিজ জন্ম স্থান গড়গোবিন্দপুর-সখীপুর তথা সমগ্র পাহাড়ী এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যান নিঃস্বার্থ নিরলস ভাবে। বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের পর শেখ মোহাম্মদ হাবীব এই দলের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। প্রতিটি থানা পর্যায়ে কমিটি গঠিত হলে শেখ হাবীব সখীপুর থানা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনোনীত হন। তিনি কয়েক মেয়াদে উক্ত পদে বহাল ছিলেন। অদ্যাবধি তিনি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অবিচল আস্থাশীল।
প্রয়াত হায়েত আলী সরকারের বংশধর বর্তমান প্রজন্ম আলহাজ্ব আবদুল বারেক সরকারের তিন ছেলে ও চার মেয়ে সন্তান। বড়ো ছেলে শেখ আলমগীর সরকার সৌদি আরব প্রবাসী। মেজো ছেলে শেখ জাকির হোসাইন সরকার রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে শেখ জাহাঙ্গীর সরকার রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী। তাঁর বড়ো মেয়ে মনোয়ারা বেগমের স্বামী আঃ ছামাদ মিয়া একজন বস্ত্র ব্যবসায়ী। মেঝ মেয়ে জোছনা বেগমের স্বামী মোঃ আঃ বারী সখীপুর সরকারি মুজিব কলেজে ‘করণিক’ পদে কর্মরত। সেঝ মেয়ে সুমেলা বেগমের স্বামী মোঃ ছিদ্দিক হোসেন কুয়েত প্রবাসী। ছোট মেয়ে নাজমা বেগমের স্বামী মোঃ শাহজাহান মিয়া বিদেশ থেকে এসে ব্যবসার সহিত জড়িত।
শেখ হাবীব সরকারের দুই পুত্র; কোনো কন্যা সন্তান নেই। জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ মোহাম্মদ মেনন সরকার ইতালী প্রবাসী। কনিষ্ঠ পুত্র শেখ মোহাম্মদ হাসনাত সরকার রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানবীশ আইনজীবী।
কালের চক্রে প্রতি বছর ১৫ই সেপ্টেম্বর আসে-যায় বারবার। সুদীর্ঘ ৪১ বৎসর যাবৎ চলছে এই ধারাবাহিকতা। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং হায়েত আলী সরকারের পরবর্তী প্রজন্মের যৌথ উদ্যোগে ঘটা করে উৎযাপন করা হয় এই দিবসটি। প্রতি বছর ১৫ই সেপ্টেম্বর সকাল ১০.০০টায় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও এলাকাবাসী সমন্বয়ে মরহুমের কবরে ফুলের তোড়া দিয়ে সন্মান প্রদর্শন করতঃ ফাতেহা শরীফ পাঠান্তে দোয়া-মোনাজাত করা হয়। আমার বিশ্বাস, অনন্তকাল এই কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে।
Leave a Reply