বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৫, ২০২৩
Homeসাহিত্য-সংস্কৃ‌তিবাঙালির বাঙালিয়ানা

বাঙালির বাঙালিয়ানা

- Advertisement -spot_img

12745670_968974246516973_1342600512891105851_n

আলীম মাহমুদ জুনিয়র :

স্বাগত ১৪২৩।
শুভ নববর্ষ। পুরাতনকে বিদায় জানিয়েই নতুনের শুভাগমন। বছর পেরিয়ে নতুন বছর। স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলো আরও একটি বছর। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, আর  পাওয়া না পওয়ার মধ্য দিয়েই কেটে গেলো বছরটি।
পহেলা বৈশাখ। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব কৃষ্টি। বাংলা নববর্ষ বাঙালি  জাতির  চিরায়ত বাংলার একটি দিন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দাপটে যখন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসে, তখনই পহেলা বৈশাখে ‘বাংলা নববর্ষ’ আবির্ভুত  হয় আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির স্বকীয়তা নিয়ে। বৈশাখ ঈদ কিংবা পূজার মত ধর্মীয় অনুভূতি নয়, সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের সার্বজনীন উৎসব। বাঙালির প্রাণের মিলনমেলায় পরিণত হয় এদিন। প্রাণের মিলনের টানেই বসে বৈশাখী মেলা। বাজে বাঁশি-ঢোল,আসে নাগর দোলা, হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা, দোকানে দোকানে পড়ে হালখাতার হিড়িক। তরুণী সাজে বনফুলে, তরুণের মনে বাজে প্রেমর বোল। বাঙালি ফিরে যায় বাঙালিয়ানায়। খায় পান্তা-ইলিশ, পরে ধূতি-পাঞ্জাবী,  ভীড় করে রমনার বটমূলে ছায়ানটের উৎসবে। অন্তত একদিনের জন্য হলেও ফিরে যাই বাংলায়। একদিনের জন্য হলেও হই  বাঙালি। পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙালি হওয়ার প্রেরণা জাগায়। আমাদের স্বতন্ত্র সমৃদ্ধ, নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার প্রেরণা জাগায়। বাংলা নববর্ষ আসে নতুন স্বপ্ন নিয়ে, উদ্ভুদ্ধ করে নতুন সৃষ্টিতে। জাগিয়ে তোলে নিজের ভেতরের সৃষ্টিশীলতাকে, নিজের ভেতরের বাঙালি সত্ত্বাকে।
আজকের এই সার্বজনীন বৈশাখী উৎসব হঠাৎ করে শুরু হয়নি, রয়েছে তার সুদীর্ঘ ইতিহাস। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারমাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকা শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল,  উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল, নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে  থেকেই পালিত  হতো। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরে সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, একসময় এমনটি ছিলনা। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখে ‘আর্তব’ বা ‘ঋতুধর্মী’ উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষি কাজ, কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের  যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর  উপরই নির্ভর করতে হতো।
ভারতবর্ষে মুঘল স¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর স¤্রাটরা  হিজরি  পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলতোনা। এতে অসময়ে কৃষকদের  খাজনা দিতে বাধ্য করা হতো।  খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়ের লক্ষ্যে মুঘল  স¤্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। স¤্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতিবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন ও হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।  ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ খেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই  গণনা পদ্ধতি কার্যকর  করা হয় আকবরের সিংহাসনে আরোহনের সময় (৫ নভেম্বর  ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এর নাম ছিল ‘ফসলি সন’ পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা বর্ষ’ নামে পরিচিত হয়।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে  চৈত্র মাসের  শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ  করতে বাধ্য করা হতো। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো।  এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রূপ পরিগ্রহ করে বর্তমানে সার্বজনীন  সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। তখনকার সময় এই দিনের মূল উপলক্ষ ছিল হালখাতা।  হালখাতা বলতে ব্যবসায়ীরা এদিন তাদের নতুন হিসাবের খাতা খুলতেন। বিশেষ করে স্বর্ণকারেরা। ওই দিন মিষ্টান্নসহ বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও করা হতো। এই প্রথাটি এখনও অনেক অংশে প্রচলিত আছে।
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিভিড় যোগাযোগ। নতুন জামা-কাপড়, পান্তা-ইলিশ, ডাক-ঢোল, বাঁশি শোভাযাত্রা,  সব মিলিয়ে বাঙালির শতভাগ বাঙালিয়ানা।

-লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মুজিব কলেজ, সখীপুর।

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img
Must Read
- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img