বুধবার, অক্টোবর ৪, ২০২৩
Homeশিক্ষাঈদুল আযহার তাৎপর্য

ঈদুল আযহার তাৎপর্য

- Advertisement -spot_img

img_5987

বছর ঘুরে আবার ফিরে এসেছে পবিত্র ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। সারা বিশ্বে মুসলমানরা হিজরী বর্ষের দ্বাদশ মাস জিলহজ্বের ১০ তারিখে ঈদুল আযহা উদযাপন করে। আরবের অনেক দেশে একে বড় ঈদ, ঈদুল কুবরা বা কুরবানীর ঈদও বলা হয়ে থাকে। অন্যান্য দেশেও এর নিজস্ব ভিন্ন নামও রয়েছে তবে এর অর্থ ও তাৎপর্য অভিন্ন। দুনিয়ার সব মানুষ নানাভাবে বিশেষ কয়েকটি দিনকে আনন্দ-উৎসবের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছে। জাতি, জ্ঞান ও ধর্ম ভেদে ভিন্ন ভিন্ন আদলে এসব উৎসব উদযাপন করে থাকে। একথা সত্য যে ধর্মের ভিত্তিতেই অধিকাংশ উৎসব উদযাপন করা হয়। আর তাতে ধর্মের মর্মবাণী ও লোকাচারের প্রতিফলন ঘটে। সর্বশেষ খোদায়ী বিধান ইসলাম মানবজাতির মুক্তির পয়গাম নিয়ে এসেছে। ঈদ উৎসবে তার সে চিরন্তন মানবিকতার আবেদন দেখতে পাওয়া যায়। ঈদ এক অনন্য উৎসব। অন্য জাতি ও ধর্মের উৎসবের মতো নয় ঈদ। খোদার প্রতি আত্মনিবেদন ও মানবতার কল্যাণে নিরলস প্রচেষ্টা চালানোর অকুণ্ঠ আবেদন ধ্বনিত হতে দেখতে পাওয়া যায় ইসলামী বিশ্বাসে, ইবাদত-বন্দেগী ও আনন্দ-উৎসবে। মহান আল্লাহ তা’য়ালার আদেশে নিজ পুত্র ইসমাঈল আ:  কে আল্লাহর জন্য কুরবানী করার হযরত ইব্রাহীম আ: এর ইচ্ছা ও ত্যাগের কারণে আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করে দেয়ার লক্ষ্যে মুসলমানরা পবিত্র হজ্বের পরের দিন ঈদুল আযহা উদযাপন ও পশু কুরবানী করে। আল্লাহ তা’য়ালা ইব্রাহীম আ: এর আনুগত্যে সন্তুষ্ট হন এবং পুত্রের পরিবর্তে তাকে পশু কুরবানী করার নির্দেশ দেন। ইব্রাহীম আ: -এর সে সুন্নাত অনুসরণে ঈদুল আযহার সময় মুসলমানরা পশু কুরবানী করেন।
মুসলমানদের দু’টি ঈদ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। একমাস রোযা পালনের পর পহেলা শাওয়াল ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয়। এর দু’মাস দশ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আযহা। পবিত্র কুরআনের সূরা আল বাকারার ১৯৬ নম্বর আয়াতে ঈদ উদযাপনের মূল ভিত্তি দেখতে পাওয়া যায় পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদাতে ‘ঈদ’ শব্দটি দেখতে পাওয়া যায়, যার অর্থ হলো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আনন্দ-উৎসব। ঈদ অর্থ বার বার ফিরে আসাও বুঝায়। তাই ইবনুল আরাবী বলেছেন, ঈদ নামকরণ করা হয়েছে এ কারণে যে তা প্রতি বছর নতুন সুখ ও আনন্দ নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে। আরবীতে ঈদুল আযহা অর্থ হচ্ছে আত্মত্যাগের উৎসব। বাংলা, উর্দু, হিন্দী, গুজরাটী এবং মালয়ী ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অষ্ট্রোনেশিয় ভাষায় আত্মত্যাগের আরেকটি আরবী শব্দ কুরবান ব্যবহার করা হয়। এসব  দেশে ঈদুল আযহাকে বলা হয় কুরবানীর ঈদ। আফগানিস্তান ও ইরানে বলা হয় ঈদে কুরবান। চীনা ভাষায় ঈদুল আযহাকে বলা হয় কুরবান জিয়ে আর উইঘররা বলেন কুরবান হেইত। মালয়েশীয় ও ইন্দোনেশীয়রা বলেন, হারি রাইয়া কুরবান। তুর্কীরা বলেন, কুরবান বাইরামী, আজারী ও তাতারীরা, বসনীয় ও ক্রোয়েশীয়রা একই কথা বলেন। ইয়েমেন, সিরিয়া, ও মিশরসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে বলা হয় ঈদুল কবীর। এখানে কবীর অর্থ বড় অর্থাৎ বড় ঈদ। কোন কোন স্থানে বকরা ঈদও বলা হয়। নাইজেরিয়া, সোমালিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও ঈদুল আযহার ভিন্ন ভিন্ন জনপ্রিয় নাম রয়েছে। জার্মানীতে ঈদুল আযহাকে বলা হয় অপফেরফেস্ট আর হাঙ্গেরীতে বলা হয় আলদোজাতি উন্নেপ।
হযরত আনাস রা. বর্ণিত এক হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল সা. মক্কা থেকে হিযরত করে মদীনায় যাওয়ার পর দেখলেন যে সেখানকার লোকেরা জাহেলিয়াতের আমলের দু’টি উৎসব দু’দিন পালন করে। মদীনার মুসলমানরা (আনসার) তাতে অংশ নেয়। তিনি তাদেরকে বললেন যে, আল্লাহ তাদেরকে জাহেলী যুগের এসব উৎসবের পরিবর্তে দু’টি উত্তম জিনিস দান করেছেন, তাহলো নহরের (জবেহ) দিন ও ফিতরের (রোজা ভঙ্গের) দিন, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।
প্রায় চার হাজার বছর আগে মক্কা উপত্যকা ছিল জনবসতিহীন শুষ্ক ও প্রস্তরময় প্রান্তর। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নবী ইব্রাহীম আ: কে তার মিশরীয় স্ত্রী হাজেরা ও তৎকালীন তাদের একমাত্র ছেলে ইসমাঈলকে কানান (ফিলিস্তিন) থেকে আরবের মক্কা নামক স্থানে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। ইব্রাহীম (আ:) তাদেরকে মক্কার নির্জন প্রান্তরে রেখে কানানে ফিরে যাওয়ার সময় হাজেরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহ কি আমাদেরকে এখানে রেখে যেতে বলেছেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ আল্লাহ আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন।’ হাজেরা বললেন, ‘তা হলে আল্লাহ আমাদেরকে ভুলবেন না, আপনি যেতে পারেন।’ ফিরে যাওয়ার সময় ইব্রাহীম আ: তাদের জন্য কিছু খাবার ও পানি রেখে যান। তাদের খাদ্যদ্রব্য শিগগিরই ফুরিয়ে গেল। কয়েকদিনের মধ্যে তারা ক্ষুধা ও পিপাসার কষ্টে কাতর হয়ে পড়লেন। একদিন পানির সন্ধানে বিবি হাজেরা সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে উঠে দৌড়া দৌড়ি করছিলেন। তিনি একবার সাফা পাহাড়ে উঠেন দৌড়ে আবার সেখান থেকে নেমে মারওয়া পাহাড়ে উঠেন। এভাবে সাতবার এ পাহাড় ও পাহাড় দৌড়াদৌড়ি করে অবশেষে নিজ ছেলে ইসমাঈলের পাশে অবসন্ন হয়ে বসে পড়েন। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন। বিস্ময়করভাবে শিশু ইসমাঈলের পায়ের কাছ থেকে একটি ঝর্ণা উৎপন্ন হয়ে প্রচুর পানি প্রবাহিত হতে থাকে। এর মাধ্যমে তাদের পানি প্রাপ্তির বিষয় নিশ্চিত হয়। এ ঝর্ণার নাম হলো জমজম কূপ। এ ঝর্ণার পানি কেবল তাদের পানি চাহিদাই পূরণ করলো তা নয় উপরন্তু তারা ওই স্থান অতিক্রমকারী বেদুইন ও পথচারীদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাথে এর পানি বিনিময় করেন। এক বছর পর আল্লাহ তা’য়ালা ইব্রাহীম আ: কে তার পরিবারের খোঁজ নিতে ফিলিস্তিন থেকে মক্কায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। ফিরে এসে তিনি তাদের বেশ সচ্ছল অবস্থা দেখে বিস্মিত হন।
আল্লাহ তা’য়ালা জমজম কূপের পাশে একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। ইব্রাহীম ও ইসমাঈল আ: মিলে পাথর ও চুনসুরকি দিয়ে যে মসজিদ নির্মাণ করেন সেটি হলো বর্তমানের পবিত্র কাবা শরীফ। লাখ লাখ মানুষ এ মসজিদে কেবল নামায আদায় করেন না সারাক্ষণ সেখানে তাওয়াফ ও আল্লাহর যিকির চলে। ইসমাঈল আ: নবুওত লাভ করেন এবং তিনি আরব বেদুইনদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ ও আল্লাহর আনুগত্য করার আহবান জানান। জমজমের পর্যাপ্ত পানি পাওয়ার সুবাদে মক্কা একটি প্রাণ চঞ্চল মরু নগরী ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। কয়েক বছর পর ইসমাঈল ইব্রাহীম আ: এর জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার বিষয়ে পরিণত হন। আল্লাহ ইব্রাহীম আ: কে তার সবচেয়ে প্রিয়বস্তুকে তার নামে কুরবানী করার আদেশ দেন। এ প্রিয় বস্তু হলো তার একমাত্র সন্তান প্রিয় পুত্র ইসমাঈল। আল্লাহর আদেশে ইব্রাহীম আ: তা পালনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ইসমাঈলকে কুরবানী করতে নিয়ে যওয়ার পথে শয়তান তাদেরকে আল্লাহর আদেশ পালনে বিরত রাখতে কুমন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করে। তারা কংকর নিক্ষেপ করে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন সে সময়। শয়তানের প্রতি তাদের এ প্রত্যাখানের কারণে এখনো হাজ্বীরা হজ্বের সময় মিনার ওই স্থানে শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করেন। প্রকাশ্যে এ কঠিন পরীক্ষার সময় ইব্রাহীম আ: এর বয়স ছিল ৯৯ বছর আর ইসমাঈলের ১৩ বছর। বহু বছর ধরে সাধনা করে ইসমাঈলকে পেয়েছিলেন ইব্রাহীম আ:। তাকে ঘিরেই ছিল তার স্বপ্নসাধ। অথচ আল্লাহ স্বপ্নে তাকে কুরবানী করার আদেশ দিয়েছেন। নবীদের স্বপ্ন সব সময় সত্য হয়। আল্লাহ নবীদেরকে স্বপ্নের মাধ্যমে তার নির্দেশ জানিয়ে থাকেন। এভাবে পিতা ও পুত্র উভয়কে আল্লাহ এক মহা কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিলেন। ইব্রাহীম আল্লাহর নির্দেশ পালনে প্রস্তুত হলেন এবং পুত্রকে তার স্বপ্নের কথা জানালেন। পুত্রও আল্লাহর আদেশ পালনে পিতার অনুগত থাকার ও আল্লাহ রাহে নির্দ্বিধায় কুরবানী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো।
তিনি বললেন, ‘আব্বু, আল্লাহ আপনাকে যা করার আদেশ দিয়েছেন আপনি তা পালন করুন। ইন শা আল্লাহ আমি ধৈর্যের পরিচয় দেব।’ আল্লাহর রাহে পুত্রকে কুরবানী দেয়া এবং পুত্রের কুরবানী হওয়ার এ ইচ্ছা প্রকাশ সবই ছিল নজীরবিহীন ঘটনা। আল্লাহর আদেশ পালনে পিতা ও পুত্র উভয়ে পরম পরাকাষ্ঠার পরিচয় দেয়ার পর ইব্রাহীম আ: তার ছেলেকে জবাই করতে শায়িত করলেন এবং ছুরি নিয়ে তাকে জবাই করতে উদ্যত হলেন ঠিক সে সময়ে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে তিনি তাদের আন্তরিক আত্মত্যাগ গ্রহণ করেছেন এবং ইসমাঈলকে নয় তার স্থলে একটি পশু কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন। এ আত্মত্যাগে আল্লাহ সন্তোষ্ট হয়ে ইব্রাহীম আ: কে তার দ্বিতীয় পুত্র ইসহাকের জন্মের সু-সংবাদ দান করেন। আল্লাহর আদেশে নিজকে ও প্রিয়তম বস্তুকে কুরবানী করার ঐকান্তিক আগ্রহ ব্যক্ত করার মাধ্যমে ইব্রাহীম আ: আল্লাহর প্রতি যে গভীর আনুগত্য ও অনুরাগ প্রকাশ করেছেন তার স্মরণে মুসলমানরা প্রতি বছর ১০ জিলহজ্ব ঈদুল আযহা উদযাপন করে। ঈদের নামাযের পর এদিনের সবচেয়ে উত্তম এবাদত হলো পশু কুরবানী করা। তিন দিন ধরে ১২ জিলহজ্ব পর্যন্ত কুরবানী করা যায়।
এক মাস রোযা পালনের পর যেমন খুশীর দিন ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয় তেমনি হজ্বের পরে ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়। অবশ্য হজ্বের সাথে কুরবানী সম্পর্কিত নয়।
ঈদের দিন মুসলমানরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামায শেষে ঈদের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সকাল সকাল গোসল সেরে উত্তম পোশাক পরে তারা ঈদগাহ বা মসজিদে সমবেত হয়। পুরুষেরা সুগন্ধি আতর ব্যবহার করে। সুন্নত অনুযায়ী ঈদগাহে এক পথ দিয়ে যাওয়া হয় আর অন্য পথ দিয়ে ফিরে আসা হয়। ঈদুল ফিতরের মতো ঈদুল আযহাও শুরু হয় দুই রাকাত ওয়াজিব নামায দিয়ে। নামায শেষে ইমাম খুতবা প্রদান করেন। খুতবা শোনা ওয়াজিব। ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতিটি পরিবার একটি মেষ বা ছাগল কিংবা উট বা গরু কুরবানী দেয়। কুরবানীর উপযুক্ত হওয়ার জন্য গরু, ছাগল, উট বা বকরীর মতো গৃহপালিত পশু সুস্থ সবল ও নিখুঁত হতে হবে। রোগাক্রান্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক পশু কুরবানী করা যাবেনা। সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানী ওয়াজিব। কুরবানী দাতা নিজে পশু জবাই করতে পারলে তা করাই উত্তম। সাধারণত কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এর এক ভাগ গরীব-দু:খী, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশী এবং অপর ভাগ নিজ পরিবারের জন্য রাখা হয়। কুরবানী আল্লাহর নামে দেয়া হয়। আল্লাহর কাছে এর গোশত, রক্ত বা অন্য কোন কিছুই পৌঁছে না, তাঁর কাছে যায় কুরবানী দাতার নিয়ত, আত্মত্যাগ। তাই কুরবানীর জন্য বিশুদ্ধ নিয়ত প্রয়োজন। কুরবানী করা পশুর গোশত দাতারা খেয়ে থাকেন। মূলত কুরবানীর পশুর অধিকাংশই অপরের জন্য বিলিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। শুধুমাত্র তিন ভাগের একভাগ কুরবানী দাতার পরিবারের জন্যে রাখা হয়।
ঈদুল আযহার সময় পশু কুরবানী করা কেবল ধর্মীয় ও মানবিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ তা নয় উপরন্তু তার অর্থনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম।

লেখক : সাইফুল ইসলাম সানি, সাংবাদিক, দৈনিক মানবজমিন, বিএসএস (অনার্স) ও এমএসএস (মাস্টার্স) -অর্থনীতি ।

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img
Must Read
- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img