সখীপুরে ৫ বছরে দুই হাজার বিবাহ বিচ্ছেদ
- Advertisement -
- মামুন হায়দার: স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে বলা হয় আত্মার বন্ধন। সেই আত্মার বন্ধন যেন দিন দিন শিথিল হয়ে আসছে। সামান্য কথা-কাটাকাটি অথবা মতের অমিল হলেই সংসার ভাঙতে পিছপা হচ্ছেন না স্বামী বা স্ত্রী। অনেক ক্ষেত্রে মধুচন্দ্রিমার আবেশও কাটে না। আবার সংসারে আসা সন্তানের ভবিষ্যৎ-ভাবনাও রুখতে পারছে না বিচ্ছেদ। কখনো কখনো দাম্পত্য কলহ গড়াচ্ছে ভয়ানক পরিস্থিতে। এদিকে বাবা-মা নিজেদের পথ বেছে নিলেও সন্তানরা ভুগছে হীনম্মন্যতায়। এই হতাশার হাত থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ পা বাড়াচ্ছে নেশার পথে। কেউ-বা যুক্ত হচ্ছে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে। অনেকে ছাড়ছে বিদ্যাপীঠ। শহরের তুলনায় গ্রামে দিন দিন এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে বলে জানিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। টাঙ্গাইলের সখীপুরে ঠিক তেমনি উদ্বেগ জনকহারে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে। গত ৫ বছরে এ উপজেলায় দুই সহ¯্রাধি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, পৌরসভার নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রার এবং পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সখীপুর পৌরসভার চারটি ও উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ১২টি নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রার কার্যালয় রয়েছে। ১৮৭৬ সালের ১ নম্বর আইনের ৬ ধারার এবং ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অর্ডিনেন্সের ( ৮নং) ৭ (১) নম্বর উপধারার বিধানমতে তিনটি ক্যাটাগরিতে বিয়ে বিচ্ছেদের নিয়ম রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর দুই পরিবার সম্মিলিত (বিয়ে বিচ্ছেদ) তালাককে ‘সি’ তালাক বা খোলা তালাক, স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে ‘বি’ তালাক এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে ‘ডি’ তালাক বলা হয়ে থাকে। প্রতিটি বিয়ে বিচ্ছেদের সার্বিক তথ্য বর-কনের সংশ্লিষ্ট পৌরমেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে চিঠির মাধ্যমে (নোটিশ) জানানো হয়। আর এটি সাধারণত নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রাররা (কাজী) চিঠির মাধ্যমে নোটিশ দেন। জানা যায়, সখীপুর উপজেলায় ২০১৬ সালে ৫৪০টি, ২০১৫ সালে ৫০৫টি, ২০১৪ সালে ৪২৫টি, ২০১৩ সালে ৩৫৬টি এবং ২০১২ সালে ৩২১টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, ২০১৬ সালেই উপজেলার কালিয়া ইউনিয়নে ১১৬, কাকড়াজান ইউনিয়নে ৮০, হাতীবান্ধা ইউনিয়নে ৪১, বহুরিয়া ইউনিয়নে ২৮, যাদবপুর ইউনিয়নে ৬৬, দাড়িয়াপুর ইউনিয়নে ২০, গজারিয়া ইউনিয়নে ৩৬, বহেড়াতৈল ইউনিয়নে ৩১ ও পৌরসভার চারটি নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে ১২২টি তিনটি ক্যাটাগরির বিয়ে বিচ্ছেদের নিবন্ধন করা হয়েছে। বিয়ে বিচ্ছেদের কারন এ প্রতিবেদক বিশিষ্টজনের কাছে জানতে চাইলে তাঁরা নানা অভিমত দিয়েছেন। বাল্যবিয়ে, পরকীয়া, বহুবিয়ে, মাদক গ্রহণে পুরুষের যৌন ক্ষমতা হারানো, দাম্পত্য কলহ, স্বামী বিদেশ থাকা, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতন, যৌতুক, স্বামীর মাদকাসক্তি, শিক্ষার হার কম, সামাজিক অবজ্ঞয়, নারীর সচেতনতার অভাব ও দারিদ্র্যতা প্রধান কারন হিসেবে পাওয়া গেছে। এদিকে, বিচ্ছেদ হওয়া অধিকাংশ বিয়েই বছরাধিকাল সময়ের বলে জানা গেছে। উপজেলার কালিয়া ইউনিয়নের নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার কাজী মাহবুব সাদিক বলেন, ‘বিভিন্ন কারনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবাসী স্বামী বা তার পরিবার কনে পক্ষকে বিয়ের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি না রাখায় বেশির ভাগ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। বিয়ের পর স্ত্রীকে পড়াশোনা করানোর কথা থাকলেও বর পক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করায় বিচ্ছেদে বাধ্য হচ্ছেন অনেক কনের পরিবার।’ উপজেলা নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রার সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী শফিউল ইসলাম বাদল বলেন, ‘ আইনি সুযোগ সুবিধা থাকায় মেয়ে পক্ষরাই বেশি তালাক (ডিভোর্স) দিচ্ছেন।’ এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ফিরোজা আক্তার বলেন, ‘আগে নারীর ক্ষমতায়ন ছিল না। পুরুষদের অত্যাচার সহ্য করে নীরবে সংসার করেছে। এখন মেয়েরা সচেতন, শিক্ষিত। তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় তাঁদের সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এখন মেয়েরা আর আগের মতো নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে চায় না।’ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী সরকার রাখী বলেন, ‘বিয়ে বিচ্ছেদের নানাবিধ কারণ রয়েছে। এসব কারনগুলো প্রতিকারে সকলের এগিয়ে আসা উচিৎ, তবে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা কমাতে অবশ্যই বাল্যবিয়েকে প্রতিরোধ করতে হবে।’ সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, ‘অসম বয়সী কিশোর-কিশোরীরা অনেকটা না বুঝেই প্রেম করে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। ফলাফল অল্প দিনেই বিয়ে-বিচ্ছেদ নয়তো ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি। অবুঝ বয়েসে বিয়ের পর মানিয়ে নিতে পারে না অনেকেই। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আন্তরিক হয়ে সহায়তা না করলে বিপদ আরও বেশি। এ সময় তারা না পারে পরিস্থিতি সামাল দিতে, না পারে ফেলে আসা নিজ পরিবারের কাছে ফিরে যেতে। গভীর হতাশা নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এ যাত্রায় ঘটতে পারে বিয়ে-বিচ্ছেদও। অল্প বয়সে বিয়ে-বিচ্ছেদের পরিণতিও হয় মারাত্মক। এদিকে, আইনগতভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ হওয়ায় এমন বিয়ের ঘটনা ঘটলে আইনের মুখোমুখি হতে হবে ছেলে-মেয়ে এবং বিয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের। অন্যদিকে, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ১৮ বছর বয়সের নিচে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলে লিঙ্গ পরিবর্তনের মতো মারাত্মক ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু আমাদের সমাজেও এমন ভুলে জড়িয়ে অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াচ্ছে অনেক কিশোর-কিশোরী।’
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -