

প্রায় অদৃশ্য স্পর্শাতীত এক দানবের থাবায় পুরো পৃথিবী আজ বিমূঢ়। পৃথিবীর মানব সভ্যতা আজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে দোদুল্যমান। হাজার বছর আগে ডাইনোসর প্রজাতির চির প্রস্থানের মতো করে মানব সম্প্রদায় বিলুপ্তির পথে হাঁটছে না তো? এমন বিষাদক্লিষ্ট-বিষণœ উদাসী ভাবনায় মন- বিক্ষিপ্ত। কোন পথে যাচ্ছি আমরা? করোনা ভাইরাস নামক অতি ক্ষুদ্র এক অদৃশ্য দানবের জটিল ধাঁধাঁয় নিমজ্জিত এই গ্রহের ধনী-দরিদ্র তথা সকল পর্যায়ের মানুষ। কাউকে পরোয়া করে না এই অদৃশ্য দানব। আধুনিক চিন্তার প্রাগ্রসরতা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমারোহ, চিকিৎসা ব্যবস্থার সর্বোত্তম উপযোগিতার ব্যবহার কিংবা পারমাণবিক বোমা-হাইড্রোজেন বোমা বা জাগতিক কোন কিছু দিয়েই মানববিশ্ব করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারছে না। মানব সভ্যতার উৎকর্ষের উপাচার আজ যেন মূল্যহীন। তবে কী মানুষের সীমানাবিহীন স্বপ্নের রাজত্ব-সভ্যতা ধ্বংসের মুখে? মানব সভ্যতার উন্নতির সীমা পরীক্ষার করার জন্য প্রকৃতির বৈরিতায় ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’ নামে স্বীকৃত প্লেগ রোগটি ছড়িয়ে পড়ে চীনের ভূখ- থেকে আর শুধু ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে মাত্র ছয় মাসে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ। ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে মর্তলীলা সাঙ্গ হয় কমপক্ষে আড়াই কোটি মানুষের। পৃথিবীর ইতিহাসে ১৩৪৬ খ্রিন্টাব্দের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ এর মতো আলোচিত মহামারী সর্ম্পকে অনেকেই ওয়াকিবহাল। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল বিধায় একে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে নামকরণ করা হয়েছিলো। তৎকালীন সময়ে ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশদ্বয়ের বাণিজ্য হতো এই কৃষ্ণ সাগরের মাধ্যমেই আর নোঙরকৃত খাদ্যদ্রব্যের জাহাজে অনায়াসে ঠাঁই নিয়ে নিতো অগণিত ইঁদুর এবং তারাই ছিল প্লেগ রোগের প্রধান জীবাণুবাহক। ১৩৪৭-৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চার বছরের এই সময়কাল ছিল ‘ব্ল্যাক ডেথ’ এর সবচেয়ে বিধ্বংসী সময়। সমসাময়িক কালে ইউরোপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এই অভিশপ্ত মহামারী। ‘ব্ল্যাক ডেথ’ মহামারীর প্রভাব টিকে ছিল অন্তত ২০০ বছর এবং এতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারায় বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘ইয়েলো ফিভার’ রোগটি মহামারীর আকার ধারণ করে। এতে নগরের দশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ মারা যায়। এরই মধ্যে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে দেখা দেয় ‘দ্য থার্ড প্লেগ’ এবং বিশ্বে এটিই সবচেয়ে বিস্তৃত আকারে ছড়িয়ে পড়ে। তৃতীয় প্লেগের উৎপত্তি হয় চীনে। ক্রমেক্রমে প্লেগ ছড়িয়ে যায় ভারত, আফ্রিকা, ইকুয়েডর, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশে। প্রায় দুই দশক স্থায়ী এ মহামারীতে প্রাণ হারায় প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামক ভয়ঙ্কর দানবের থাবা। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ রোগে প্রায় তিন কোটি মানুষের জীবন নাশের ঘটনা মানুষকে জানিয়ে যায় প্রকৃতি ও মানব সভ্যতা এই দুইয়ের সমন্বয় খুব জরুরী। কিন্তু মানুষ তার ইচ্ছে ও আধিপত্যের মোহে প্রকৃতিকে বৈরী করে তোলে। প্রকৃতি তার নিজের প্রয়োজনে স্বকীয় দাপট মাঝে মধ্যে দেখিয়ে যায়। ২০১৩-২০১৫ সালে প্রকৃতি প্রদত্ত ‘ইবোলা’ নামক ভাইরাস। এই ভাইরাসের খামখেয়ালিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
প্রকৃতির নানা নামের ভয়ঙ্কর থাবায় অদৃশ্য দানবেরা মানব সভ্যতা ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) নামক প্রকৃতির দিগন্ত বিস্তারি রূপ ইতোমধ্যেই বিশ্ব থেকে চার লাখ ২৫ হাজারের অধিক লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছে এবং আরও ৭৭ লাখেরও বেশি মানুষ অদৃশ্য এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের দাপট দেখানো তথাকথিত অতি শক্তিধর দেশগুলোও আজ অসহায়। মানব সভ্যতা বিনাশে উদ্যত এই ‘করোনা’ নামক ভাইরাসের কারণে সারাবিশ্ব আজ কম্পমান। তিলে তিলে গড়ে ওঠা সভ্যতা টিকবে কী-না? তা নিয়ে সমগ্র মানবজাতি আজ উদ্বিগ্ন।
অনাগত দিনগুলোয় মানুষের দুর্দশা হয়তো আরও বাড়বে। সেই দুর্দশার জন্য আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখাা উচিত। এই ‘করোনা’ নামক ভাইরাস শুধু মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে তা নয়, বরং এর প্রভাবে তৈরি হবে দারিদ্র্য-অনাহার, দুর্ভিক্ষ এবং বিচ্ছেদ-ক্রোধ এর মতো সুগভীর জটিলতা। অনেকের অতিপ্রিয় মানুষও হয়তো চোখের সামনে থাকবেনা। এসব ভেবেই বা কি লাভ? ‘সময়’ নামক নিয়তি সবকিছু ঠিক করে দেবে নিশ্চয়ই। হয়তো সময় লাগবে কিন্তু অদৃশ্য দানবের তাড়কা রাক্ষসীর মত ভয়ঙ্কর রূপের বিরুদ্ধে মানুষ তথা প্রকৃতির উপাদানই জয়ী হোক। রাতের আঁধার কেটে যেমন ভোরের আলোয় ঝলমলে হয় প্রকৃতি, তেমনি করোনাকালের রাতের আঁধার কাটবে, আবার নতুন প্রাণের স্পর্শে সবাই একত্রিত হবো ইনশাআল্লাহ।
-লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজ, সখীপুর, টাঙ্গাইল।