
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এর প্রাদুর্ভাব ও ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, এর প্রকোপে থমকে গেছে গোটা বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষের প্রাত্যহিক সব ধরনের কার্যক্রম। বিশ্ববাসী কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে। চলমান মহামারি থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের একটাই চাওয়া- কবে মুক্তি মিলবে? কখন স্বাভাবিক হবে কর্ম-জীবন, পরিবেশ ও মানুষ? পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা এড়াতে বিশ্বের আক্রান্ত দেশগুলো লকডাউনে যায়। যার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ঘরের চার দেয়ালে বন্দী হয়ে যায়। সংকটময় এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই শিশু থেকে শুরু করে সববয়েসী মানুষের মধ্যে ভর করে করোনা আতঙ্ক। সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। আর এই উৎকণ্ঠার মধ্যে বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ঝুঁকি বিবেচনায় গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয় অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, নিত্য পণ্যের ব্যবসা ব্যতিরেকে অন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, ইটের ভাটা। জুন মাসের শুরু থেকে সীমিত আকারে লকডাউন ওঠে গেলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ রয়েছে। লকডাউনকালে নিষিদ্ধ করা হয় সকল ধরনের গণজমায়েত ও গণপরিবহন। সব কিছু ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর একসাথে অনেক মানুষ গৃহবন্দী হওয়ায় চারপাশ তাই অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায়। প্রতিদিনের পরিবহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া নেই, মানুষের হৈ-হুল্লোড় ভাব নেই, চায়ের দোকানে আড্ডা নেই, রাস্তার মোড়ে যুবক ছেলেদের অবাধ চলাচলেও মুখরিত নয়। এতে কমেছে বাতাসের দূষণ, শব্দ দূষণ, সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ ও নিত্য ঘটা ইভটিজিং এর মাত্রা।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় ভারত ও চীনের পরে বাংলাদেশের অবস্থান। অন্যদিকে, বড় শহরগুলোর মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বে রাজধানী ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। ‘ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল বার্ডেন ডিজিজ প্রজেক্টে’ এর প্রতিবেদনে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণকে চার নম্বর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর লাখ-লাখ মানুষ মারা যায়। আশার কথা হলো- লকডাউনের কারণে কার্বন নিঃসরণ কমে আসায় বায়ুম-লের ওজোন স্তরে যে বিশাল ক্ষত বা গর্ত তৈরি হয়েছিল তা পৃথিবী নিজেই সারিয়ে তুলছে। তথ্যসূত্র: কোপারনিকাস অ্যাটমোস্ফিয়ার মনিটরিং সার্ভিস (সিএএমএস) ও কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সি৩এস)।
মহামারি আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষ যখন বেঁচে থাকার শঙ্কায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে বিশ্ব পরিবেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, লকডাউন সময়ে প্রকৃতিতে পড়েছে এক অদ্ভুত প্রভাব। প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে তার নিজস্ব রূপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, আকর্ষণীয়ভাবে কমে গিয়েছে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন। পাশাপাশি কমেছে দূষণের মাত্রাও। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরেও বাতাসের দূষণ অনেক কমেছে। যানবাহন ও শিল্প কারখানার কালো ধোঁয়া, ইট ভাটার দূষিত ধোঁয়া বর্তমানে ঢাকা কিংবা অন্য কোন শহরের আকাশে নেই বললেই চলে।
স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে থমকে দেয়া করোনা ভাইরাস প্রকৃতিতে এনে দিয়েছে আমূল পরিবর্তন। মানুষের মধ্যে হঠাৎ ভর করেছে অন্য চিন্তা, নতুন কিছু করার প্রবণতা, সৃষ্টিশীল কাজে মনোনিবেশ, বই পড়ার অভ্যাস, বিকেলবেলা ছাদে ও খোলা মাঠে বাহারি রঙের ঘুড়ি উড়ানোর মহা আয়োজনÑ এ যেন প্রকৃতির অন্যরকম আশীর্বাদ। নীল আকাশে খেলা করছে সাদা মেঘের ভেলা, সকাল-দুপুর-বিকেল বেলা নানা পাখির আনাগোনা ও তাদের বৈচিত্র্যময় ডাকাডাকি, রাতের আকাশে মিটি মিটি করে জ্বলছে তারা, মাঠে-ঝোপ ঝাড়ে জোনাকি পোকার স্মৃতিময় আলো, গাছে গাছে ফুটেছে মন মাতানো হরেক রকমের ফুল। রাতের গভীরতায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। এ যেন সত্যিই বাংলার চিরাচরিত রূপ। যা এক সময় উপভোগ করেছে গ্রাম-বাংলার প্রতিটি মানুষ। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারেও নেই কোন কোলাহল। সৈকতের বুকে মানুষের পদচারণা নেই। ‘সাগরলতা’ তার নিজস্ব শিল্প নৈপুণ্যের ছোঁয়ায় সবুজ আস্তরণ তৈরি করছে। সবুজ বিশালতায় ফুটেছে বাহারি জাতের নাম না জানা রঙিন সব ফুল। বাসা বাঁধছে লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও গাঙ চিলসহ নতুন-পুরান সব পাখির দল। সাগরপাড়ে বাড়ছে কচ্ছপের অবাধ বিচরণ। বহু বছর পর সমুদ্রে ডিগবাজি খেলায় মেতেছে ডলফিন। বাংলাদেশের অন্যান্য পর্যটণ কেন্দ্রগুলোও বদলে যাওয়ার মিছিলে যুক্ত হয়েছে, বদলে গেছে গাছ-পালা, লতা-পাতা ও আঙিনা। ছোট-বড় শহরগুলোও দূষণমুক্ত। নেই প্রাণের নৈমিত্তিক কোলাহল। পাহাড়গুলো ফিরে পেয়েছে তার সৌন্দর্য, ছোট ছোট লেক, ঝর্ণা, আর নদীর পানি এতোটাই স্বচ্ছ, যা আগে হয়তো কখনো কেউ দেখেই নি।
যারা দিনের পর দিন কাজের চাপে কিংবা ব্যস্ততার কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন লকডাউনে সেই সম্পর্কগুলো নতুনত্বে অবগাহন করার সুযোগ হয়েছে। একসঙ্গে খাবার খাওয়া, খাবার টেবিলে কথাবার্তা, একসঙ্গে ঘরের কাজ করা, একে অন্যকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, বাড়িতে নানান ধরণের খাবার তৈরি, বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে পুরনো সব খেলা ক্যারাম কিংবা লুডু খেলে সময় কাটানো, পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যটিও তার কাছের মানুষকে সবসময় কাছে পাচ্ছে, একসাথে কোনো মুভি দেখা, সময় পেলেই গান শোনা, গান শেখা, ধর্মীয় মূল্যবোধে নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা ইত্যাদি।
এসব কিছুর পরও অজানা ভয় মানুষকে প্রশান্তি দিতে পারছেনা। আমাদের নিজেদের কিছু নিত্য অভ্যাসের পরিবর্তন করে পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। বৈশ্বিক মহামারী থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে হলে মানুষের নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও সহিষ্ণু হয়ে শ্রেষ্ঠতর পৃথিবী গড়তে বিরল এক সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এমনটা মনে করলে মনের জোর কমে যাবে। করোনাভাইরাস মহামারি কতদিন চলবে, সেটার ওপর নির্ভর করে নয় পরবর্তীতে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। একজন ফিউচারোলজিস্ট ‘ডেভিড প্যাসিগ’। তিনি ইসরায়েলের বার ইলান ইউনিভার্সিটির ‘স্কুল অব এডুকেশনের’ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ল্যাবের প্র্রধান। তাঁর লেখা একটি বই ‘দ্য ফিউচার কোড এন্ড ২০৪৮’ বেশ আলোচিত। ডেভিড প্যাসিগ বর্ণনা এর বর্ণনামতে, ‘সম্ভাব্য পরিস্থিতি’ বলে, তার অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা অনেক কঠিন হবে। তা সত্ত্বেও একটা সময়ের পর মানুষ তার স্বাভাবিক আচরণে ফিরে যাবে, যেমনটি ঘটেছিল স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির পর। তিনি অন্য একটি গবেষণাতে বলেছেন, এরকম ক্ষেত্রে মানুষের আচরণে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন ঘটবে। “মানুষে-মানুষে সংস্পর্শ কমে যাবে এবং অন্যের সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে মানুষের মনে যে ভয় সেঁটে গিয়েছে, তা কাটাতে দশ হতে বিশ বছর পর্যন্ত যাবে। আর মানুষের এই আচরণের কারণে নতুন ধরণের সেবা, শিল্প, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে অনেক কিছু গড়ে উঠবে।”
–লেখক: মো. শরীফুল ইসলাম, প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজ, সখীপুর, টাঙ্গাইল।
-এসবি/সানি