শনিবার, ডিসেম্বর ২, ২০২৩
Homeজাতীয়কণ্ঠশিল্পী এম.এ হাশেমের নিরবধি পথচলা

কণ্ঠশিল্পী এম.এ হাশেমের নিরবধি পথচলা

নিজস্ব প্র‌তি‌বেদক: বাঙালির জীবন-দর্শনে প্রাণস্পর্শী যে গীতিধর্মীতা হাজার বছর ধরে বহমান ছিল আজ তা অনেকটাই ম্লান বিজাতীয় হৈ হুল্লুরপূর্ণ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে। প্রাণের সঙ্গে যে বিষয়বস্তু ও পরিবেশন রীতির কোনোই সংযোগ নেই তার বহমান ¯স্রোত জোর করে গতিপ্রাপ্ত করানোর চেষ্টা থেকে যে কোনো উপায়ে সরে আসতে হবে আমাদের সবাইকে। নইলে যে আমাদের সমৃদ্ধ অতীত অস্তিত্বের শেকড় আলগা হয়ে যাবে। হ্যাঁ বিজাতীয় শুদ্ধ সংস্কৃতি গ্রহণে আমাদের কোনোই কার্পণ্য থাকার কথা নয়, যদি তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের চিরন্তন চাওয়া-পাওয়াকেই প্রতিনিধিত্ব করে। দুঃখ হয় যখন দেখি, বিদেশী র‌্যাম্প-রক গানে দেশীয় নবীন শিল্পীরা গা ভাসিয়ে দিচ্ছে আর এ-প্রজন্মের তরুণ সঙ্গীত পিপাসুরা তাতে সর্বোচ্চ মনযোগী হয়ে উন্মাতাল আচরণে দর্শকাসন প্রকম্পিত করছে। গান যে নিরেট শোনবার ও শোনাবার বিষয় এবং হৃদয় দিয়ে পরম আকুলতায় উপলদ্ধি করার বিষয়- এ কথা আজ তরুণ প্রজন্মের কাছে অনেকটাই নির্বাসিত। বিষয় ও ভাববস্তু বিহীন সর্বগ্রাসী উন্মাতাল এসব র‌্যাম্প-মেটাল-রক ব্যান্ড গানের বেলাল্লাপনার অন্তরালে ক্রমাগতই ঢাকা পড়ছে আউল-বাউল, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কীর্ত্তন-প্রসাদীসহ জীবনধর্মী লোকবৃেত্তর অমূল্য সম্পদগুলো- যা আমাদের পূর্ব পুরুষগণ সর্বোচ্চ যত্নে লালন করে গেছেন আমাদেরই জন্যে। অথচ আমরা তা বিকাশ বা সংরক্ষণ তো করছিই না বরং আমাদের চরম উদাসীনতায় তা উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। সম্মিলিতভাবে আমাদের কি উচিৎ নয় ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া এসব অমূল্য সম্পদ পূণরুদ্ধার করে এ প্রজন্ম এবং অনাগতের জন্য সংরক্ষণ করা? যে কোনো মূল্যে আমাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে তার বিকাশ ও বিস্তারে আত্মনিয়োগ করতে হবে এখনই। আর কালক্ষেপণ নয়- বাঙালির লোক শিক্ষার বাহন যে লোকগীতি তা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে সকলকে।

উল্লেখিত আক্ষেপ ও সম্ভাবনাধর্মী কথাগুলো বলছিলেন শিল্প সংস্কৃতির কিছু মানুষ থাকেন যারা নীরবে নিভৃতে শুধু তার দায়িত্বে থাকা কাজটাই করে যান। নিজেকে তারা অন্যের আলোচনায় রাখতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। শুধু তাই নয়, কোন রকম প্রচারণা থেকেও তারা আড়ালে থেকে যান। ঠিক তেমনি একজন অসাধারণ কণ্ঠশিল্পী বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একাধিক শাখায় তালিকাভূক্ত এম.এ হাশেম। শিল্পী এম.এ হাশেম টাঙ্গাইলের সখীপুরে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৬ সালে। স্বত:স্ফুর্ত প্রাণাবেগ আর প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার সেই দুরন্ত কৈশর বেলায়ই সংগীতে প্রথম হাতে খড়ি হয়। হাতে খড়ি বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্থে সঙ্গীত শিক্ষাটা সে বয়সে হয়ে ওঠেনি। হতে পারে পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলটি ঠিক সেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে সক্ষম হয়নি। তাতে কি? নিজস্ব ঐকান্তিক ভাবনার শিল্পগত তাড়া ও আঞ্চলিক লোক সংস্কৃতির প্রেরণাতো অর্ন্তগত একটা পরিণতি দেবেই। বলা যায়- এভাবেই এম.এ হাশেমের বেড়ে ওঠা এবং শিল্পী হয়ে ওঠা। আর পাড়া গাঁয়ের বৈঠকি আসরে পরিবেশিত পালাগান জারি-সারি ও যাত্রাগান শুনে শুনে গানের প্রতি আজন্ম আসক্তির শেকড় গাড়ে সে সময় থেকেই। ঐ বয়সে কোন রুপ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া গাইতে গাইতে গায়েন হয়ে স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরোনোর আগেই সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অনেকগুলো পুরুস্কার ঘরে জমা করেন শিল্পী এম.এ হাশেম। বাল্যবন্ধু রতনের ঐকান্তিক শিল্প সাহচর্য ওই বয়সে তার অনেক খানি সঙ্গীত পিপাসা বাড়িয়ে দিয়েছিল। স্কুল-কলেজে পড়ার পাঠ্যসূচি অতিক্রম করতে করতে তীব্রভাবে অনুভব করেন সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। কিন্তু কখনো কোন সঙ্গীত গুরুর সান্নিধ্যলাভ করতে সমর্থ হননি। ১৯৮৮ সালে ডিগ্রি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েই তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ সানোয়ার হোসেন ও ওস্তাদ কবীর হোসেনের কাছ থেকে কয়েক বছর শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। এসময় থেকেই তিনি নিজেকে সংগীত জগতের এক নিরলস পথিক ভাবতে শুরু করেন, যার অগ্রযাত্রা আজও অমলিন ভাবে বহমান রয়েছে।
শিল্পী এম.এ হাশেমের অভিজ্ঞতার ভান্ডারে সংগীতের বৈচিত্র্যময় ধারার সম্মিলন ঘটলেও তিনি মূলত: আধুনিক, পল্লীগীতি ও নজরুল সংগীতের প্রতিই হয়ে উঠেন বিশেষ অনুরাগী। সংগীতের এই নির্দিষ্ট গতি পথই শিল্পী এম.এ হাশেমকে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একাধিক সংগীত শাখায় তালিকাভূক্ত হতে সহায়তা দান করেছে। শিল্পী এম.এ হাশেম এই দু’টি জাতীয় গণপ্রচার মাধ্যম থেকে একই সঙ্গে আধুনিক, পল্লীগীতি, নজরুল এবং ‘‘মেঠোসুর” অনুষ্ঠানে যুগপদ তালিকাভূক্ত শিল্পী হয়ে নিয়মিতভাবে পরিবেশন করে যাচ্ছেন দেশ, মানুষ ও মাটির গান। এ পর্যন্ত শিল্পীর দু’টি এ্যালবামও বাজারে বের হয়েছে। “পিরিতের বিষ” নামের এ্যালবামটি ২০০২ সালে বের করেছে দেশের স্বনামধন্য অডিও এ্যালবাম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান “সোনালী প্রোডাক্টস”। ২০০৫-এ যৌথভাবে “বুকের যন্ত্রণা” নামে বের হয় শিল্পীর সর্বশেষ এ্যালবাম “সিডি জোন” থেকে। দুটি এ্যালবামেই শিল্পীর স্বভাবজাত আধুনিক ও লোকগীতি আঙ্গিকের গান গুলো শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। যার অধিকাংশ গানেরই সুরারোপ করেছেন তিনি নিজে।
১৯৯৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত উপজেলা সংগীত বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক হিসেবে নিজেকে নিরলস ভাবে এক যুগ নিয়োজিত রেখেছিলেন। আছেন উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে। কর্মজীবনে তিনি একজন স্কুল শিক্ষক। ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন কন্যা সন্তানের জনক। পারিবারিক সহযোগিতা ও সহমর্মীতায় মা-বাবা, ভাই-বোন ও স্ত্রী কানিজ ফাতেমার সানুগ্রহে শিল্পী এম.এ হাশেম বর্তমানের সংগীত সাফল্য ধারণ করছেন- একথা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক “জলসা সাংস্কৃতিক সংগঠন” (দলীয় সংগীতে তালিকাভূক্ত বিটিভি)-এর হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগীত পরিবেশন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগীত পরিচালনা, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংগীত বিভাগের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত সংগীত পরিবেশন শিল্পী এম.এ হাশেম-এর সাংস্কৃতিক জীবনের
পরিমন্ডলকে করেছে অনেক বেশি সুসংহত ও মাধুর্যপূর্ণ। যথোপযুক্ত পরিবেশ ও নিখাত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শিল্পী এম.এ হাশেম যে, কণ্ঠশিল্পীর মহোদয় উৎকর্ষ সাধন ও দেশজ
লোক ও আধুনিক গানের সুবিন্যস্ত বিস্তার ঘটাতে পারবেন- একথা সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায়।

 

-এসবি/সানি

আরও খবর

জনপ্রিয়