মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৩
Homeজাতীয়বিএ হালিম মাস্টার: একজন ব্যতিক্রম পদবী ধারী শিক্ষা গুরু

বিএ হালিম মাস্টার: একজন ব্যতিক্রম পদবী ধারী শিক্ষা গুরু

- Advertisement -spot_img
আবদুর রাজ্জাক (বিএবিএড):
লেখকের ছবি

সাধারণত যোগ্যতা বা পদবী লেখা হয় নামের শেষে। কিন্তু টারশিয়ারি যুগের মধ্য পাহাড়ে ঘটেছে এর ব্যতিক্রম; যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিগত ১৯৩৬ সালের ২০ শে আগস্ট প্রত্যুষে  তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত টাঙ্গাইল  মহকুমার বাসাইল থানাধীন গজারিয়া ইউনিয়নস্থ মুচারিয়া পাথার গ্রামে মায়ের কোল আলো করে  জন্ম গ্রহণ করেন ফুটফুটে চাঁদের মতো এক শিশু। পিতা -মাতা আদর করে নাম রাখেন মোহাম্মদ আবদুল হালিম মিয়া। এই শিশুই বড়ো হয়ে এক দিন “বি,এ হালিম” নামে পরিচিত হয়ে উঠেন সমগ্র পাহাড়ের বুকে।

বিএ হালিম সাহেবের পিতার নাম মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ বাছাতন নেছা। ধর্মভীরু পিতা ছেলেকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে ভর্তি  করেন ভালুকা থানার কাচিনা জুনিয়র মাদ্রাসায়। জুনিয়র ফাইনাল পরীক্ষায় মেধা বৃত্তি সহ উত্তীর্ণ  হয়ে ভর্তি হন কাউলজানী নওশেরীয়া হাই মাদ্রাসায়। উক্ত মাদ্রাসা থেকে ১৯৫০ সনে তিনি কৃতিত্বের সহিত এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।অতঃপর করটিয়া সা’দত কলেজেে ভর্তি হয়ে ১৯৫৩ সনে আই,এ পাস করে বিএ ক্লাসে  ভর্তি হন।  তিনি ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দে উক্ত কলেজ থেকে  বি,এ  ডিগ্রী অর্জন করেন। পঞ্চাশের দশকে সমগ্র পাহাড়ী এলাকায় একমাত্র তিনিই সর্বপ্রথম বিএ পাস করেন। তাঁর অভূতপূর্ব সাফল্যে সারা পাহাড় জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাঁকে এক নজর দেখতে এবং তাঁর মুখে ইংরেজী শোনার জন্য বহু দূর-দূরান্ত থেকে বহু লোক আসতে থাকে। এভাবে লোক মুখে মুখে তিনি হয়ে উঠেন বি,এ হালিম । তাই বাবা-মায়ের রাখা আদুরে নামটি যায় হারিয়ে।
বিএ পাসের অব্যবহিত পরেই তিনি বেশ ক’টি সরকারি চাকুরীর নিয়োগ পত্র প্রাপ্ত হন। কিন্তু  তিনি তা গ্রহণ করেন নি। কারণ, তাঁর জীবনের  লক্ষ্য ছিল, তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন। শিক্ষক হয়ে সমাজের সর্ব প্রকার অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূরীভূত করে অবহেলিত-বঞ্চিত অজো পাড়াগাঁয়ে শিক্ষার আলো প্রজ্বলন করবেন। জীবনের সেই লক্ষ্য পূরণকল্পে তিনি সর্বপ্রথম গাজীপুরস্থ শৈলট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। শুরু হয় তাঁর কাঙ্খিত শিক্ষকতা জীবন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর তিনি তৎকালীন ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় ১৭ টি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তার মধ্যে ১২ টি হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যেসব স্কুলে তিনি দায়িত্ব পালন করেন, সেগুলোর মধ্যে শৈলট হাই স্কুল, নিজ মাওনা  হাইস্কুল, কচুয়া পাবলিক হাইস্কুল, গাজীপুর  হাইস্কুল, বাটাজোড় বিএম হাইস্কুল, কালমেঘা  ইলিমজান হাইস্কুল সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। নব্য প্রতিষ্ঠিত জুনিয়র বা হাইস্কুল সরকারী মঞ্জুরী লাভের পূর্ব শর্ত ছিল গ্রাজুয়েট হেডমাস্টার । কিন্তু তখনকার দিনে গ্রাজুয়েট হেডমাস্টার পাওয়া খুব দুস্কর ছিল। তাই  তিনি ১২ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতঃ মঞ্জুরী পেতে সহায়তা করেছেন।
পিতার পছন্দ মোতাবেক ১৯৫৮ সনে বাসাইল থানার কাউলজানী ইউনিয়নস্থ বাদিয়াজান গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি নজ্জেশ আলী তালুকদারের মেয়ে মোসাম্মৎ মরিয়ম বেগমের সহিত তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে তিনি  অত্যন্ত সুখী ও সমৃদ্ধশালী ছিলেন।
সখীপুরবাসীর আহবানে বিএ হালিম সাহেব ১৯৬৫ সালের ১লা অক্টোবর ‘সখীপুর  পিএম পাইলট হাইস্কুলে যোগদান করেন। প্রায় একযুগ তিনি অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে  সখীপুর-গড়গোবিন্দপুর এলাকার মাটি ও মানুষের সাথে তাঁর গভীর আত্মীক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় ।  ক্রমে ক্রমে তিনি সখীপুরের সকল উন্নয়ন ভাবনার মধ্য মণি হয়ে উঠেন। ১৯৫৬ সনে প্রতিষ্ঠিত সখীপুর থানা দাবীর মুখপত্র “দি হিলি ইউনাইটেড এসোসিয়েশন” এবং “সখীপুর থানা দাবী কমিটি’র অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি সরকারি সা’দত কলেজে অধ্যয়নকালে আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। তদানিন্তন  বাসাইল থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি  ছিলেন পাহাড়ের কৃতি সন্তান জনাব আবু সাঈদ  বিএসসি। তাঁর সঙ্গে বিএ হালিম সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। সেই সুবাদে দীর্ঘদিন তিনি বাসাইল থানা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন।
১৯৬৪ সনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান কর্তৃক প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ বা বুনিয়াদি গণতন্ত্রের আওতায় অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে তিনি অবিভক্ত গজারিয়া ইউনিয়নের একজন  প্রভাবশালী মেম্বার নির্বাচিত হন। বলতে গেলে, তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন ও পরামর্শক্রমে ১৯৬৫ সনে গড়গোবিন্দপুরের কৃতি সন্তান আলহাজ্ব মোখতার আলী তালুকদার সংখ্যা গরিষ্ঠ মেম্বারদের ভোটে গজারিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছেষট্টির ছয়দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাংগঠনিক অবদান অবিস্মরণীয় যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সার্বক্ষণিক পাশে থেকে তিনি মুক্তি বাহিনীগণকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তিনি গজারিয়া ইউনিয়নের ‘রিলিফ চেয়ারম্যান’ মনোনীত হন। তিনি সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সহিত স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুঃস্থ-দরিদ্র-অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা ও পূনর্বাসন কার্যক্রমে তাঁর অনবদ্য ভূমিকা অবিস্মরণীয় ১৯৭৬ সালে সখীপুর থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর  তিনি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোনীত হন। তাছাড়া তিনি সখীপুর থানা উন্নয়ন কমিটির সন্মানিত সদস্য ছিলেন দীর্ঘ দিন। জার্মান-বাংলাদেশ যৌথ প্রকল্পের আওতায় সখীপুর থানা উন্নয়ন ও রাস্তা নির্মাণ কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কালের বিবর্তনে সারা পাহাড় জুড়ে উন্নয়নের জোয়ার বইতে শুরু করে । উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে  উঠে বিভিন্ন এলাকায়। বি,এ হালিম সাহেবের  নিজ গ্রাম পাথারপুরে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “জনতা  উচ্চ বিদ্যালয়” নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। পাহাড়ের আরেক গুণীজন সর্ব জনাব  এসএম চান মাহমুদ বিএসসি বিএড ছিলেন উক্ত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। তিনি ১৯৭৮ সালের ১লা জানুয়ারি পদত্যাগ করতঃ নিজ এলাকার ‘কালমেঘা ইলিমজান উচ্চ বিদ্যাালয়ে’ যোগদান করেন। যার প্রেক্ষিতে বিএ হালিম সাহেব সখীপুর পিএম পাইলট হাইস্কুলের হেড মাস্টার পদে ইস্তফা দিয়ে ১৯৭৮ সনের ২রা জানুয়ারি পাথারপুর জনতা উচ্চ বিদ্যালয়ের হেড মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একটানা বিশ বছরের অধিক সময় সুনামের সহিত দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯৮ সালের ৩০শে এপ্রিল তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পরেও প্রায় একযুগ  তিনি জনগণের খেদমতে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। সুদীর্ঘ কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালের ২রা সেপ্টেম্বর এই মহৎপ্রাণ মহানুভব বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী মহান মানুষটি ইহধাম ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর কয়েক দিন। তিনি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনী, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, গুণগ্রাহী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তাঁর তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে বড়ো ছেলে গোলাম মোস্তফা ইংরেজী বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করতঃ দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী। মেঝো ছেলে গোলাম মওলা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বর্তমান গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত মেম্বার হিসেবে জনসেবায় নিয়োজিত আছেন। ছোট ছেলে গোলাম মাহমুদ বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা পেশায় কর্মরত আছেন। বড়ো মেয়ে মোসাম্মৎ হেলেনা আক্তার সখীপুরের সর্বজন  পরিচিত বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জনাব শেখ মোহাম্মদ হাবীবের সুযোগ্যা সহধর্মিণী, মেঝো মেয়ে মোসাম্মৎ হেনা আক্তারের বিয়ে হয়েছে ডাকাতিয়া নিবাসী জনাব আকবর হোসেনের নিকট। তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। সেঝো মেয়ে মোসাম্মৎ মাফিয়া আক্তারের স্বামী মো. ছানোয়ার হোসেন গাজীপুরের পূবাইল আইডিয়াল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক। সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে মোসাম্মৎ রাবেয়া আক্তারের স্বামী মোঃ মুসা খান বর্তমানে ইতালী প্রবাসী।

পূর্ব টাঙ্গাইলের সেরা ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক সমাজের মধ্যমণি, অগণিত শিক্ষার্থীর আদর্শ শিক্ষক, আপামর জনসাধারণের যোগ্য অভিভাবক সর্বজনাব বিএ হালিম সাহেবের তিরোধান দিবস (২রা সেপ্টেম্বর) উপলক্ষে আমি  শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমীন।

-লেখক: সাবেক সিনিয়র শিক্ষক সখীপুর পিএম পাইলট মডেল গভঃ স্কুল এন্ড কলেজ, সখীপুর, টাঙ্গাইল।
-এসবি/সানি
- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img
Must Read
- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img