
সাইফুল ইসলাম সানি: করোনা মহামারি প্রতিরোধে উন্নত দেশগুলো প্রাথমিকভাবে লকডাউন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। পদ্ধতিটি খুব দ্রুতই সংক্রমণ কমিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এ পদ্ধতি আমাদের দেশেও বেশ কয়েকবার প্রয়োগ করা হয়েছে। সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। কিন্তু আমাদের উদাসীনতা ও অসচেতনতার কারণে সংক্রমণের স্রোতকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। অতএব বিষয়টি এখন স্পষ্ট যে, লকডাউন সাময়িকভাবে কয়েকদিনের জন্য সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে, কিন্তু এটি দীর্ঘ মেয়াদে প্রয়োগ করার মতো কোনো পন্থা নয়। সময় অনেক গড়িয়েছে, এখন দেশের জনগণের আর্থিক অবস্থা ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে লকডাউনের বিকল্প কিছু ভাবা উচিত। অন্য দেশগুলো কী পদক্ষেপ নিয়েছিল ওই চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিয়ে নিজস্ব চিন্তাধারা দিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সরকারের ভাবা উচিত নতুন কোন পদ্ধতিটি অবলম্বন করলে আমাদের দেশ, জনগণ ও অর্থনীতি সচল থাকবে।

করোনার শুরু থেকেই শুনে আসছি আক্রান্তদের দ্রুত ঘরে (সেল্প আইসোলেশন) চলে যেতে হবে। অর্থাৎ সুস্থদের নিজ নিজ কাজকর্মে ফেরার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। এটা একটা সহজ সমিককরণ, কিন্তু এই সমিকরণটি মেলাতে হবে ভিন্ন কোনো কৌশলে।
আমি কোভিড-১৯ পজেটিভ হওয়ার পর হিসাব করে দেখেছি- একজন সুস্থ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কমেপক্ষে তিন থেকে পাঁচদিন পর বুঝতে পারেন তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। তবুও পরীক্ষা না করা পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষেই আক্রান্ত কি না সন্দেহ থেকে যায়।
এই যে, আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম, কবে জেনেছি? যেদিন কোভিড-১৯ টেস্টের ফলাফল হাতে পেয়েছি। ওইদিন থেকে আমি সেল্ফ আইসোলেশনে ছিলাম। বাস্তবতা হলো- আমি কিন্তু আক্রান্ত হয়েছি আনুষ্ঠানিকভাবে আকান্ত হওয়ারও প্রায় পাঁচদিন আগে। সবাই কিন্তু তাই হয়। কারণ করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট বা ফলাফল হাতে আসতেও কমপক্ষে দুইদিন অপেক্ষা করতে হয়।
এর আগে বেঁচে থাকার তাগিদে আমি/আমরা অবাধে চলাফেরা করি। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এভাবে চলাফেরা করাটাও স্বাভাবিক। জীবন ধারণের জন্যেই তা করতে হয়। কারণ আমরা থেমে গেলেই আমাদের অনেকের পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখও যে থেমে যায়! ঠিক এখানেই আমাদের (জনগণের) একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি এবং সরকারকে আরও একটু আন্তরিক হয়ে নতুন কৌশল প্রয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি।
করোনায় প্রকৃতপক্ষে আক্রান্ত এবং প্রাতিষ্ঠানিক আক্রান্ত হওয়ার মাঝখানে মাত্র তিন থেকে পাঁচটি দিন সময় থাকে। লকডাউনের বিকল্প হিসেবে এই পাঁচটি দিন যেকোনো উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই সংক্রমণ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশ্বাস করি। আশাকরি প্রক্রিয়াটি ব্যাপক হারে সংক্রমণ রোধে এবং সবকিছু চলমান রেখেই লকডাউনের চেয়ে বেশি কার্যকর হবে।

টিকা প্রদান কর্যক্রম সামর্থ অনুযায়ী চালমান রাখতে হবে। অন্যদিকে যেহুতু ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়ায়, তাই হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর আগেই আমাদের ঘরে ফিরতে হবে। ভাইরাসের একটি লক্ষণও যদি দেখা দেয়, তাৎক্ষণাৎ বাইরের জগতটাকে সুস্থদের জন্যে ছেড়ে দিয়ে সন্দেহভাজন আক্রান্তদের ঘরে ফিরতে হবে। পূর্ণ লক্ষণ দেখা দিলে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে ঘরেই অবস্থান করতে হবে।
অনেকেই বলবেন- ‘ঘরে যে যেতে বলছেন! অনেকের ঘরেতো পর্যাপ্ত খাবার নেই!’ টানা কয়েকদিন ঘরে বসে থাকলে পরিবারসহ না খেয়ে থাকবেন আমাদের দেশে এমন পরিবারের সংখ্যাও কিন্তু নেহায়েত কম নয়। মূলত ঘরে খাবার না থাকা, ভবিষ্যতে অর্থ সঙ্কটে পড়ার ভয় এবং অসচেতনতার কারণে আমরা প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দেওয়া মাত্র প্রাতিষ্ঠানিক কোভিড-১৯ আক্রান্ত স্বীকৃতি পেতে চাইনা। কেনো চাইনা? মানুষের ভয়ের পাত্র হওয়ার পাশাপাশি আমাদের উপার্জনের পথটিও বন্ধ হয়ে যায়।
এই সময়টায়ই সরকারের আন্তরিক হওয়ার প্রকৃত সময়। সুস্থদের অবাধ চলাচলের জন্যে বাইরের জগতটাকে ছেড়ে দিয়ে যাঁরা ঘরবন্দী হবেন, ঠিক ওই সময় থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে সন্দেহভাজন অসুস্থ ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে।
সন্দেহভাজন আক্রান্ত বা প্রকৃতই আক্রান্ত পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া মানে ওই পরিবারকে বাড়ি গাড়ি দামি কাপড়-চোপড় কিনে দেওয়া নয়। ওই পরিবারের সদস্যদের মুখগুলো যেনো সচল থাকে কেবল এমন হালকা দায়িত্ব। অর্থাৎ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত পরিবারকে নিশ্চিত খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা দিতে হবে। তবেই আক্রান্ত সদস্যের মনোবল দৃঢ় হবে। তাঁরা ঘরে ফিরতে দ্বিধাবোধ করবে না। প্রয়োজনে ওই পরিবারটিকে তাৎক্ষণিক ভাতা প্রদান সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। এতে সরকারের যে খরচ হবে, আশাকরি তা লকডাউনের ক্ষতির চেয়ে বেশি হবেনা।
মূলকথা হলো-
‘কোভিড-১৯ -এর যেকোনো বা একটিমাত্র লক্ষণ দেখা দিলেই মানুষকে সেল্ফ আইসোলেশনে চলে যেতে বাধ্য করতে হবে। সরকার তাঁর সার্বিক দায়িত্ব নিতে বাধ্য থাকবে।’
অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে করোনা মহামারির সঙ্গে অনেকটা “ম্যালথাসের জনসংখ্যা তথ্যের” মিল খোঁজে পাই। যাইহোক, ওসব অন্য প্রসঙ্গ। তবে লকডাউন বিষয়টি আমার কাছে গাছের শিকড় কেটে উপরে পানি ঢালার মতো মনে হয়। এভাবে বারবার লকডাউন দিলে দেশের অর্থনীতি ভালোর দিকে যাবেনা। বরং ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। এ বিষয়টি গত কয়েকবার ও চলমান লকডাউনের চিত্র দেখে সকলেই অনুমান করেছেন নিশ্চয়। সময় অনেক গড়িয়েছে, এই সময়ে একটুও যদি অভিজ্ঞতা অর্জন হয়ে থাকে, তা কজে লাগিয়ে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে গোড়া থেকে; নতুন ও ভিন্ন কোনো কৌশলে। এভাবে গাছের শিকড় কেটে উপরে পানি ঢেলে নয়। বারবার লকডাউন দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে নিম্নগামী করা ঠিক হবেনা। লকডাউন অর্থনীতির জন্যে হরতালের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
আসুন নতুন কৌশল চিন্তা করি। যেমন: লকডাউনে দেশের অর্থনীতির যে পরিমাণ ক্ষতি হয় এবং যে পরিমাণ অর্থ অপরিকল্পিতভাবে ত্রাণের জন্য ব্যয় হয়, সেই সম পরিমাণ অর্থ পরিকল্পিতভাবে শুধুমাত্র কোভিড-১৯ লক্ষণ দেখা দিয়েছে অথবা আক্রান্ত হয়েছে এমন পরিবারের জন্য ব্যয় করুন। এতে আক্রান্তদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং আক্রান্ত হলেই না খেয়ে মরতে হবে এমন ধারণা থেকেও জনগণ বেরিয়ে আসবে।
লকডাউন দিয়ে দেশের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে অপরিকল্পিতভাবে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। গরিব হোক আর ধনী হোক সুস্থদের নিজ নিজ কাজে থাকতে দিন। শুধুমাত্র কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দিয়েছে বা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে তাঁদেরকে সহায়তা দিন।
কৌশল বাস্তবায়নে ধনী-দরিদ্র বিবেচনা না করে, যাঁদের কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দিয়েছে এবং যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে সঠিক যাচাই-বাছাই করে কেবলমাত্র তাঁদের জন্যে একটি সম্মানজনক কোভিড-১৯ ভাতাও চালু করা যেতে পারে।
এতে দেখা যাবে: কোভিড-১৯ -এর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি অর্থের লোভে হোক আর নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচাতে হোক মানুষ তাৎক্ষণিক সেল্ফ আইসোলেশনে চলে যাবে। প্রয়োজনে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর হলেও তখন সকলের সমর্থন পাওয়া যাবে।
ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বলতে হচ্ছে- একটি শ্রেণি সরকারি সহায়তার লোভে পড়ে কোভিড-১৯ পজেটিভ দেখানোর জন্যে ঘরে বসে মিথ্যার আশ্রয়ও নিতে পারেন। অবশ্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের এসব অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনাকে নমনীয় কৌশলে সামাল দিতে হবে।
কৌশলটির বাস্তবায়ন খুব সহজ হবে তা বলছি না। কারণ এর জন্যে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সারাদেশে করোনাকালীন বিশাল তহবিল গঠন করতে হবে। প্রাথমিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, এতো অল্প সময়ে এমন বিশাল পরিকল্পনা ও তহবিল গঠন করা সম্ভব হবে কি? তবে দেশব্যাপী তহবিল গঠন করা খুব একটা কঠিন হবে বলেও মনে করছি না।
উদাহরণ হিসেবে একটিমাত্র উপজেলার হিসাব তুলে ধরতে পারি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী আমার নিজ উপজেলা টাঙ্গাইলের সখীপুরে করোনার প্রথম ধাপে ত্রাণ বাবদ সরকারি (জিআর প্রকল্প) ২০৮ মেট্রিক টন চাল, জিআর ক্যাশ ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা, শিশু খাদ্য বাবদ বরাদ্দ ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তৎকালীন ইউএনও ফেসবুকে এ হিসাব প্রকাশ করেছেন, যা এখনো দৃশ্যমান। চালের দাম ন্যূনতম ৪০ টাকা কেজি হলেও ২০৮ মেট্রিক টন চালের মূল্য হয় ৮৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। বিতরণকৃত চালের দাম, ক্যাশ বরাদ্দ ও শিশু খাদ্যের বরাদ্দ মিলে সর্বমোট বিতরণ হয়েছে ৯৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। করোনাকালীন তহবীল গঠনে একটি উপজেলার জন্যে প্রায় এককোটি টাকা কম নয় নিশ্চয়! টাকাতো খরচ নিয়মিতই হচ্ছে, সেই অংকটাই একটু ভিন্ন কৌশলে খরচ করলে অসুবিধা কী?
দক্ষতা ও সততার সঙ্গে প্রতিটি উপজেলায় কোভিড-১৯ ভাতা প্রদানের কৌশলটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ঘরের বাইরের অংশটুকু ভাইরাসমুক্ত থাকবে। সংক্রমণ কমে আসবে বহুলাংশে, সচল রাখা সম্ভব হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানাসহ সকল খাত। সচল থাকবে অর্থনীতি। সচল থাকবে দেশের উন্নয়নের গতি।
পরিশেষে বলবো- উপরের কৌশলটি আমার ব্যক্তিগত একটি চিন্তামাত্র। এমন শতাধিক চিন্তা হয়তো সরকারের কাছে রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য চিন্তাটি একবার পরিক্ষামূলকভাবে হলেও প্রয়োগ করে দেখুন। অন্য দেশের কৌশলের পিছু না হেটে নিজ দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ ও অর্থনীতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজেদের চিন্তা চেতনা কৌশল ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করি। সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা ‘আমরা এই মহামারী থেকে মুক্তি চাই। সকল বিপদ থেকে মুক্ত হোক আমাদের সোনার বাংলাদেশ।’
-লেখক: সাইফুল ইসলাম সানি (এমএসএস, অর্থনীতি), সাংবাদিক, সখীপুর, টাঙ্গাইল।